হোটেল মোটেল রিসোর্টে তো অনেক থাকা হলো। এবার কি একটু একঘেয়ে লাগছে? অনেক মানুষের মধ্যে থাকতে চান না? বাইরে বেশি দিন অবস্থান করার খরচ নিয়ে চিন্তিত? বাসার পরিবেশটা মিস করছেন খুব?
তাহলে আপনার জন্য অপেক্ষা করছে দারুণ এক বিকল্প, নাম ‘হোম স্টে’। অত্যন্ত স্মার্ট ও আন্তরিক এই সার্ভিস পৃথিবীর দেশে দেশে জনপ্রিয় হয়েছে। রাইড শেয়ারিংয়ের মতো নিজের বাসাও অন্যের সঙ্গে শেয়ার করছে মানুষ। অনলাইনভিত্তিক সেবা, অনেকে জানেন না, চালু আছে বাংলাদেশেও। বিশেষ করে রাজধানীর ঢাকা ও পর্যটন এলাকাগুলোতে নীরবে এর বিস্তার ঘটে চলেছে।
হোম স্টে মানে, ঘরে বসত করা। কারও বাসায় হয়ত একটি বা দুটি শয়ন কক্ষ একদমই ব্যবহৃত হয় না। মাসের পর মাস শূন্য পড়ে থাকে। কী দরকার? তার চেয়ে বরং কেউ এসে থাকুক। থাকার বিনিময়ে কিছু অর্থও যদি পাওয়া যায়, মন্দ কী? হ্যাঁ, এমন চিন্তা থেকেই অনেকে নিজ গৃহে হোম স্টে সেবা চালু করেন। বাসার কক্ষ শুধু নয়, পুরো ফ্ল্যাট বা আস্ত বাড়িও অতিথির জন্য ছেড়ে দিতে দেখা যায়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অতিথি এবং অভ্যর্থনাকারী থাকেন একই ছাদের নিচে। ড্রইং রুমে একসঙ্গে বসে গল্প আড্ডা জমান, টেলিভিশন দেখেন। ব্যবহার করতে পারেন কম্পিউটার, ইন্টারনেটও। একই ডাইনিং টেবিলে খাবার গ্রহণেরও সুযোগ থাকে। চাইলে অতিথি নিজেও রান্না করে খেতে পারেন। সব মিলিয়ে নিজের বাড়িতে থাকার অনুভূতি। বাড়ির মালিক যেমন তার অতিথিকে সাদরে গ্রহণ করার মানসিকতা নিজের মধ্যে ধারণ করেন, তেমনি অতিথিকেও নির্ঞ্ঝাট সুহৃদ হয়ে উঠতে হয়। তবেই সম্ভব হয় সেবা দেয়া-নেয়া।
হোম স্টে সেবার ক্ষেত্রে ব্যবসায়িক মানসিকতা বিশেষ প্রাধান্য পায় না। তাই সুযোগ-সুবিধা গ্রহণের বিপরীতে খরচ হয় কমই। সীমিত আয়ের মানুষ যারা ভ্রমণ করতে, ট্রেনিংয়ে অংশ নিতে বা বিভিন্ন উৎসব সভা সেমিনারে যোগ দিতে বিদেশে যান, তাদের জন্য হোম স্টে এক ধরনের আশীর্বাদ।
সেবাটি, আগেই বলেছি, ইন্টারনেট নির্ভর। ওয়েবসাইট বা এ্যাপসের মাধ্যমে নিজের বাসা বাড়িকে হোম স্টে সার্ভিসের অন্তর্ভুক্ত করা যায়। অতিথিকেও নিজের নামে এ্যাকাউন্ট খুলতে হয়। আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ওয়েবসাইট বা এ্যাপস ব্যবহার করেই চলছে হোম স্টে সার্ভিস। সার্ভিসটি দেয়া ও নেয়ার বড় মাধ্যম ভ্যাকেশন রেন্টাল অনলাইন মার্কেট‘airbnb.com।’ ২০০৮ সালে প্রতিষ্ঠিত ওয়েবসাইটে প্রায় ১৯২ দেশের ৩০,০০০ শহরের ২০০,০০০ বাড়ির তালিকা রয়েছে। এখানে নিজের নামে খোলা এ্যাকাউন্ট থেকে সারা দুনিয়ার শূন্য বাসা বা কক্ষের তথ্য জেনে নিতে পারেন পর্যটকরা। হোম স্টে সার্ভিসের অন্তর্ভুক্ত বাসা বাড়ি বিভিন্ন মানের, বিভিন্ন মূল্যের হতে পারে। যার যেমন পছন্দ রুচি ও সাধ্য সে অনুযায়ী সেবা গ্রহণ করে থাকেন। সারা দুনিয়ার মতো সেবাটি চালু আছে বাংলাদেশেও। খোঁজ-খবর করে দেখা যাচ্ছে, সারাদেশে প্রায় ৪০০ বাসা বাড়ি এই নিয়মে অতিথি গ্রহণে প্রস্তুত। এক শহরের মানুষ অন্য শহরে গিয়ে এ সেবা গ্রহণ করছেন। তবে অতিথিদের বড় অংশ বিদেশী বলেই জানা যাচ্ছে। কিছুটা লম্বা সময়ের জন্যই অবস্থান করেন তারা। নানা দেশ থেকে আসা এই অতিথিরা বেশি অবস্থান করেন ঢাকাতেই।
পরিচিত এ্যাপস এবং ওয়েবসাইট ঘুরে দেখা যায়, এখন এই কোভিডের কালেও ঢাকার বহু বাসার দ্বার অতিথিদের জন্য খোলা রয়েছে। কিছু কিছু বাসা ভীষণ সুন্দর। গোছাল। দেখেই চোখ জুড়িয়ে যায়। তেমনই একটি একতলা বাড়ি খুঁজে পাওয়া গেল ধানমন্ডি এলাকায়। সামনে খোলা চত্বর। সেখানে সবুজ ঘাসের গালিচা। উডেন ফ্লোর। ভেতর ও বাইরের ছবি দেখে লুফে নিতে ইচ্ছে করে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বাড়িটি ২০১৭ সাল থেকে সেবা দিয়ে যাচ্ছে। অভিজাত বলেই খরচ একটু বেশি। প্রতি রাতের জন্য ৪০ ডলার। বাড়ির হোস্ট এক যুবক। নাম কাজী। অতিথি সেবায়ও ভাল তিনি। এত ভাল যে, ‘সুপার হোস্ট’ স্বীকৃতি অর্জন করেছেন।
গুলশানে নিজের বাসার একাংশ ভাড়া দিচ্ছেন সনি নামের এক গৃহিণী। গত ১০ বছর ধরে বাসাটি ব্যবহার করছেন অতিথিরা। জানা গেল, এরই মাঝে প্রায় ৩০০ অতিথি বাসাটিতে অবস্থান করেছেন। ১ মাস শুরু করে থেকে ২০ মাস পর্যন্ত টানা অবস্থান করেছেন তারা। এ থেকে বোঝা যায়, দেশে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে রুম শেয়ারিং।
মিরপুরের নিজের বাসা শেয়ার করেন মৃদুল। ৪ হাজার টাকায় থাকা যাচ্ছে তার বাসাটিতে। এমন আরও অনেকেই হোটেল মোটেলের বিকল্প গড়ে তুলেছেন।
বিদেশীদের কথা বলছিলাম, ওয়ারির টিপু সুলতান রোডের একটি বাসায় নিয়মিত বিরতিতে অবস্থান করেন বিদেশীরা। বাসার হোস্ট স্বপন কুমার। আর গেস্ট আসছেন ভারত কিংবা জাপান থেকে। বাসার ছবিতে দেখা গেল, এক জাপানী অতিথি ঘরের মানুষজনের সঙ্গে এক ডাইনিং টেবিলে বসে খাবার গ্রহণ করছেন। সবারই হাসিমুখ। জানা গেল, উভয় পক্ষ বেশ উপভোগ্য করে তুলেছেন ব্যাপারটিকে।
উত্তরা থেকে নিজের বাসা শেয়ার করার অভিজ্ঞতা জানিয়ে আব্দুল হামিদ নামের এক প্রবীণ বলছিলেন, আমার নতুন বাসা। ছয়তলা বাড়ির দুটি ফ্ল্যাট ভেঙ্গে এক করায় বেশ বড় হয়েছে জায়গাটা। কিন্তু বাসায় থাকার তেমন কেউ নেই। ছেলে-মেয়রা বিদেশে। আমি আর আমার ভাই থাকি। কখনও এক সখনও নাতি আসে। বাকি সময় খুব খালি খালি লাগে। বিদেশে ছিলাম যখন দেখেছি, অনেকে বাড়তি রুম ভাড়া দিয়ে দেন। সেভাবে আমিও এখন আমার বাসার দুটি কক্ষ ভাড়া দিচ্ছি। টাকা বড় কথা নয়, কত মানুষের সঙ্গে পরিচয় হচ্ছে! বেশ লাগে এখন।
কিন্তু কোন তিক্ত অভিজ্ঞতা কি হচ্ছে না? জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি কোন সমস্যায় পড়িনি। আসলে ভদ্র শিক্ষিতরাই এ ধরেন সার্ভিস গ্রহণ করতে আসে।
একই রকম ইতিবাচক মন্তব্য করলেন বিমানবন্দর সড়কের একটি ফ্ল্যাটে গত কয়েকদিন কাটিয়ে যাওয়া সুমন। কোভিডের মধ্যেই সিলেট থেকে ঢাকায় এসেছিলেন। অভিজ্ঞতা তুলে ধরে তিনি বলেন, এই সেবার সঙ্গে যুক্ত যারা তারা যথেষ্ট স্মার্ট। সচেতন। আগেও অন্তত তিনটি বাসায় গেস্ট হয়েছি আমি। কম খরচে হোটেলে চেয়ে ভাল থাকা যায়। অন্য কোন সমস্যাও দেখিনি। পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ছিল। আত্মীয় পরিজনের মতোই বাড়ির লোকেরা খোঁজ-খবর নিয়েছেন। সব মিলিয়ে চমৎকার অভিজ্ঞতা হয়েছে বলে জানান তিনি।
জানা যায়, ঢাকার বাইরে চট্টগ্রাম, সিলেট ও কক্সবাজারসহ বেশ কিছু পর্যটন এলাকায় এই ধরনের সেবা চালু রয়েছে। সারাদেশে, বিশেষ করে দুর্গম পর্যটন এলাকায় রুম শেয়ারিং সেবাকে উৎসাহিত করতে চায় বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডও। সে লক্ষ্যে সম্প্রতি কাজ শুরু করেছে বোর্ড। এ সম্পর্কে ট্যুরিজম বোর্ডের প্রধান জাবেদ আহমেদ বলেন, দেশের অনেক প্রান্তিক এলাকায় গুরুত্বপূর্ণ পর্যটন স্পটগুলোতে পর্যটকদের থাকার তেমন কোন ব্যবস্থা নেই। সেদিকে গুরুত্ব দিয়ে সারাদেশের পর্যটন এলাকায় হোম স্টে চালু করার জন্য স্থানীয় লোকজনকে উদ্বুদ্ধ করার কাজ শুরু করতে যাচ্ছি আমরা। এই কার্যক্রমের অংশ হিসেবে গত ৩১ আগস্ট রাজধানীর বনানীতে ‘লিটল ট্রি’ নামের একটি হোম স্টে সার্ভিস প্রস্তুত করা হয়েছে। সামনের দিনগুলোতে দেশে হোম স্টে সার্ভিসকে আরও জনপ্রিয় করতে যা যা প্রয়োজন, বোর্ড করবে বলে জানান তিনি।