আশঙ্কা সত্যি হতে চলেছে। বিশে^র অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও শীতের দাপট বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ফের চোখ রাঙানি দিচ্ছে করোনা। প্রাণঘাতী এই ভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবেলায় দেশের সরকারী-বেসরকারী সকল হাসপাতালকে প্রস্তুত থাকতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। কথা হলো কোভিড-১৯ মোকাবেলায় এখনও ভ্যাকসিন চূড়ান্ত হয়নি। প্রতিষেধকের অপেক্ষায় গোটা বিশ^। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভ্যাকসিন বাজারজাত হওয়ার আগ পর্যন্ত মাস্কই প্রতিরোধের একমাত্র উপায়। এর মাধ্যমে নিজেকে ৮০ ভাগ সুরক্ষিত রাখা সম্ভব। এর সঙ্গে করোনা নিরাপত্তায় শারীরিক দূরত্ব নিশ্চিত করা, বারবার হাত ধোয়াসহ র্যাপিড টেস্টের পরামর্শ দিয়েছেন তারা। মূলত এই চারটি কাজ নিশ্চিত করা গেলে করোনা থেকে প্রায় ৯০ ভাগ নিরাপদ থাকা সম্ভব।
এদিকে আসন সংখ্যার অতিরিক্ত যাত্রী পরিবহন না করাসহ গণপরিবহনে ছয় শর্ত দিয়ে স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালন সংক্রান্ত জরুরী বিজ্ঞপ্তি জারি করেছে বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথিরিটি (বিআরটিএ)। বিশেষজ্ঞদের পক্ষ থেকে বারবার বলা হচ্ছিল, গণপরিবহন থেকেই সংক্রমণ ব্যাধি বেশি ছাড়ানোর সম্ভাবনা। এই বিবেচনায় বিভিন্ন গণমাধ্যমে দেশের নৌ-সড়ক ও রেলপথে স্বাস্থ্যবিধির বেহাল চিত্র তুলে ধরে সংবাদ প্রকাশ করা হয়। যার ধারাবাহিকতায় বুধবার এ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে বিআরটিএ কর্তৃপক্ষ।
ইতোমধ্যে আমেরিকা, ফ্রান্সসহ বিশে^র বিভিন্ন দেশ করোনার দ্বিতীয় পর্যায়ের ভয়াল থাবার শিকার। আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের ধারণা প্রথম ঢেউ থেকে দ্বিতীয় ঢেউয়ের ভয়াবহতা বেশি হতে পারে। ফলে বাড়তে পারে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা। পরিস্থিতি মোকাবেলায় গোটা বিশ^কে আগাম সতর্ক বার্তা দিচ্ছেন তারা।
সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকেই কিছুদিন ধরে শীতে সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করা হচ্ছিল। দ্বিতীয় পর্যায়ের সংক্রমণ মোকাবেলায় সরকারের উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠন করা হয়েছে। এই কমিটি বিভিন্ন মন্ত্রণালয়কে করণীয় ঠিক করার প্রস্তাব আহ্বান করে। এর মধ্যে গত ৭০ দিনের মধ্যে সবচেয়ে বেশি কোভিড-১৯ রোগী শনাক্ত হয়েছে। মঙ্গলবার গত ৫৭ দিনের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক রোগীর মৃত্যু হয়েছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে যে, করোনাভাইরাস সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হয়েছে।
এদিকে করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউ সামাল দিতে ব্যাপক হারে টেস্ট বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। আর সেক্ষেত্রে এ্যান্টিজেন ভিত্তিক র্যাপিড টেস্ট কিটের ব্যবহার শুরু করা যেতে পারে বলে মত দিয়েছেন তারা। এমন পরিস্থিতিতেই টেস্ট বাড়ানোর ওপর গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে।
স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে দেয়া তথ্য অনুযায়ী, করোনাভাইরাসে (কোভিড-১৯) আক্রান্ত হয়ে গত ২৪ ঘণ্টায় সারাদেশে ২১ জন মারা গেছেন। তাদের মধ্যে পুরুষ ১৪ ও নারী ৭ জন। সবাই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। এ নিয়ে ভাইরাসটিতে মোট মৃতের সংখ্যা দাঁড়াল ছয় হাজার ২৭৫ জনে। বুধবার স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডাঃ নাসিমা সুলতানা স্বাক্ষরিত করোনা বিষয়ক এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়। মঙ্গলবার দেশে গত ২৪ ঘণ্টায় করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ৩৯ জনের মৃত্যু হয়, যা গত ৫৭ দিনে সর্বোচ্চ। বুধবার সে সংখ্যা ফের অর্ধেকে নেমে এসেছে।
এতে বলা হয়, গত ২৪ ঘণ্টায় ১১৭টি ল্যাবরেটরিতে ১৫ হাজার ৫৯৮টি নমুনা সংগ্রহ করা হয় এবং ১৬ হাজার ৪৬৯টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়। এ নিয়ে মোট নমুনা পরীক্ষার সংখ্যা দাঁড়াল ২৫ লাখ ৮৯ হাজার ৪২১টি। ২৪ ঘণ্টায় করোনাভাইরাসে আক্রান্ত নতুন রোগী শনাক্ত হয় আরও দুই হাজার ১১১ জন। দেশে মোট শনাক্ত রোগীর সংখ্যা দাঁড়াল চার লাখ ৩৮ হাজার ৭৯৫ জনে। এ পর্যন্ত মোট সুস্থ হয়েছেন ৩ লাখ ৫৪ হাজার ৭৮৮ জন।
র্যাপিড টেস্টে সর্বোচ্চ ৩০ মিনিটে ফল পাওয়া যাবে ॥ বর্তমানে সারা দেশে ১১৬টি ল্যাবে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শনাক্তের নমুনা পরীক্ষা করা হচ্ছে। যার মধ্যে ৬৬টি ল্যাব রাজধানী ঢাকায় এবং বাকি ৫০টি ল্যাব ঢাকার বাইরে বিভিন্ন জেলায় অবস্থিত। সরকার বলছে, দ্বিতীয় ঢেউ সামাল দিতে টেস্টের সংখ্যা বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে। এছাড়া এ্যান্টিজেন টেস্ট চালু করার বিষয়েও সরকারের চিন্তা রয়েছে। তবে এগুলো কবে নাগাদ শুরু হবে সে বিষয়ে এখনও সিদ্ধান্ত আসেনি বলে জানিয়েছেন আইইডিসিআর-এর পরিচালক ডাঃ তাহমিনা শিরিন।
করোনা মোকাবেলায় চ্যালেঞ্জে গোটা বিশ্ব ॥ শীতের মৌসুমে করোনাভাইরাস সংক্রমণ বাড়ার আশঙ্কা করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) মেডিসিন বিভাগের সাবেক ডিন ও প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক ডাঃ এবিএম আব্দুল্লাহ বলেছেন, বিশ্বজুড়ে করোনা মহামারীর প্রকোপ কমছে না। ভাইরাস মোকাবেলায় হিমশিম গোটা বিশ্ব। শুধু মাস্ক পরলেই ৮০ শতাংশ করোনার সংক্রমণ ঠেকানো সম্ভব। এছাড়া শারীরিক দূরত্ব ও হাত ধোয়ার ব্যবস্থা রাখতে হবে। নিয়মিত এ তিনটি কাজ করতে পারলে করোনা সংক্রমণ রোধ করা সম্ভব।
বিআরটিএ জরুরী বিজ্ঞপ্তি ॥ করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় পর্বের ঢেউ মোকাবেলায় গণপরিবহনে স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালন সংক্রান্ত জরুরী বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি-বিআরটিএ। স্বাস্থ্যবিধি মেনে গণপরিবহন সংক্রান্ত শর্তাদি প্রতিপালনের অনুরোধ জানিয়ে বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, আসন সংখ্যার অতিরিক্ত যাত্রী পরিবহন করা যাবে না। গণপরিবহনে যাত্রী, চালক, সুপারভাইজার/কন্ডাক্টর, হেলপার এবং টিকেট বিক্রয় কেন্দ্রের দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যক্তির মাস্ক ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। তাদের হাত ধোয়ার জন্য পর্যাপ্ত সাবান পানি, হ্যান্ড স্যানিটাইজারের ব্যবস্থা রাখতে হবে।
এছাড়া গণপরিবহনসমূহ জ¦ালানি সংগ্রহ ও জরুরী প্রয়োজন ছাড়া পথে কোথাও যাত্রা বিরতি করা যাবে না। মধ্যবর্তী স্থানে যাত্রী ওঠানোর জন্য থামানো যাবে না। যাত্রা শুরু ও শেষে যানবাহন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নসহ জীবাণুনাশক দিয়ে জীবাণুমুক্ত করতে হবে।