অদৃশ্য ভাইরাসের সঙ্গে যুদ্ধ। বিশ্ব মহামারী করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে এ যুদ্ধে প্রথম সারির যোদ্ধা হিসেবে ডাক্তার, নার্সসহ প্রতিটি স্বাস্থ্যকর্মী সেবায় নিয়োজিত রয়েছেন। দায়িত্ব পালন করতে দিয়ে অনেক চিকিৎসক নার্স ইতোমধ্যেই করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুকে করেছেন আলিঙ্গন। আবার অনেকের করোনা হওয়ার পর সুস্থ হয়ে আবার ফিরেছেন মানুষের সেবায়। মৃত্যুকে ভয় না পেয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার কারণে সমুক্ষসারির যোদ্ধা হিসেবে মানুষের মনে মনে তারা ‘জাতীয় বীর’। এমন এক বীর ডাঃ তুষার। ঢাকা মেডিক্যালের এই ডাক্তার যিনি একাই প্রায় চার হাজার রোগীকে দিয়েছেন সেবা। এরমধ্যে প্রায় তিন হাজার সরাসরি করোনা রোগী।
চীন থেকে প্রথম উৎপত্তি হওয়ার পর; বাংলাদেশে কোভিড-১৯ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির কথা প্রথম জানা যায় ৮ মার্চ। আর প্রথম মৃত্যুর খবর আসে ১৮ মার্চ। বাংলাদেশে মে মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে মহামারী পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছিল এবং জুন মাসে সংক্রমণটি তীব্র আকার ধারণ করেছিল। শুরু থেকে আইইডিসিআর একগুচ্ছ হটলাইন নাম্বার, ই-মেইল এ্যাড্রেস এবং তাদের ফেসবুক পাতা জনগণের জন্য সরবরাহ ও নিশ্চিত করা হয়েছিল যাতে তারা দরকারি তথ্য বা কোভিড-১৯ সন্দেহে যোগাযোগ করতে পারেন। ২২ মার্চ থেকে সরকার ১০ দিনের সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেছিল যা পরবর্তীতে ৭ বার বর্ধিত করে ৩০ মে পর্যন্ত বাড়ানো হয়। যা ছিল এক ধরনে অঘোষিত ‘লকডাউন’। সাধারণ ছুটির মধ্যে দেশেই জরুরী সেবা, পণ্য পরিবহন, চিকিৎসা ইত্যাদি অতি-প্রয়োজনীয় ছাড়া গণপরিবহনও চলাচল বন্ধ ছিল। শুরু থেকেই ভয়ে যখন মানুষ আশপাশে আসত না তখন পাশে ছিল হাসপাতাল এবং ডাক্তার স্বাস্থ্যকর্মীরা। শুরুর দিকে ডাক্তার, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মীদের মাস্ক, পিপিই, স্যানিটাইজেশনের ব্যবস্থাসহ সংক্রামক থেকে সুরক্ষার সরঞ্জামাদি যথোপযুক্ত ছিল না। কোথাও কোথাও সরবরাহের ক্ষেত্রেও বিলম্ব হয়েছে তবে সেবা থেমে থাকেনি। মানুষ বাঁচানো, জীবন বাঁচানোর এক সংগ্রামে সেবার ব্রত নিয়ে আসা ডাক্তাররা নিজের পরিবার স্বজন রেখে ছুটেছেন মানবসেবায়। এমন একজন ডাক্তার ডাঃ মোঃ সালেহ মাহমুদ তুষার। করোনার প্রথম ঢেউয়ের অভিজ্ঞতা নিয়ে জানা গেছে, করোনা সংক্রমণের শুরু থেকে এ পর্যন্ত তিনি প্রায় চার হাজার রোগীকে বিভিন্ন সেবা দিলেও করোনা পজেটিভ ছিল ২ হাজার ৭১২ জন। মহামারী শুরুর পর কার্যকর টেলিমেডিসিন সেবা দিয়ে রোগীকে সুস্থ হওয়ার আশা দেখিয়েছেন। এমনকি করোনা রোগীদের চিকিৎসায় গড়ে তুলেছেন প্লাজমা ব্যাংক।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের (ঢামেক) মেডিক্যাল অফিসার হিসেবে কাজ করা তুষার হাসপাতালে দায়িত্ব পালন করেই থেমে থাকেননি। ফোন পেয়ে গভীর রাতেও ছুটে গেছেন রোগীর কাছে। এ ছাড়া বিপদে পড়া রোগীর জন্য অক্সিজেন সরবরাহ করেছেন। যার প্রয়োজন তার কাছে পৌঁছে দিয়েছেন এ্যাম্বুলেন্স সেবা। বিশেষ করে হাসপাতালে নিজ দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি ডাঃ তুষার টেলিমেডিসিন সেবা দিয়ে বহু করোনা রোগীকে সাহায্য করেন। আর এ কাজে তাকে ব্রডকাস্ট জার্নালিজম সেন্টার বাংলাদেশ (বিজেসি)। পরে সিটি কর্পোরেশনসহ সংশ্লিষ্ট কিছু প্রতিষ্ঠান সহায়তা করতে এগিয়ে আসে।
জনকণ্ঠকে ডাঃ তুষার বলেন, করোনা সংক্রমণ শুরুর প্রথম দিকে মার্চ মাস থেকেই আমি ঢাকা মেডিক্যালের মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপকদের সঙ্গে মহামারীতে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে আলোচনা শুরু করি। তার মতে, বাংলাদেশে স্বাস্থ্যকর্মীরা অপর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা নিয়ে শুধু মনের জোরেই করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমেছে। ঢামেকের অর্থোপেডিক্স বিভাগে কর্মরত এ চিকিৎসক অন্য আরও তিন চিকিৎসককে নিয়ে একটি টিম আকারে করোনা রোগীর স্বাস্থ্য সুরক্ষায় কাজ করে যাচ্ছেন। তিনি ও তার দল করোনা রোগীদের বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। তিনি জানান, বিজেসির সার্পোটের কারণে মহাখালীতে তিনি করোনা পরীক্ষার জন্য বুথ চালু করা যায়। এখনও প্রতি সপ্তাহে তিনদিন টেস্ট হচ্ছে। এ বুথে প্রায় ১ হাজার ৮০০-র মতো রোগীর করোনা পরীক্ষা করা হয়।
মরণঘাতী রোগ ক্যান্সারও অদম্য এ চিকিৎসকের গতি থামাতে পারেনি। তাই তো ক্যান্সার জয় করে মানবসেবায় নিজেকে সপে দিয়েছেন। তিনি জানান, আমার তিনটি ডিফারেন্ট ক্যান্সার ছিল এখন আল্লাহর রহমতে ভাল। তবে চিকিৎসাও নিতে হচ্ছে। এতকিছুর মধ্যেও দুই ঈদেও দায়িত্ব থেকে পিছুপা হননি তিনি। সে সময় করোনা আক্রান্তদের ভোর থেকে টানা টেলিমেডিসিন সেবা দিয়ে যান। করোনা শুরুর পর থেকেই বেসরকারী সংস্থা অলওয়েল.কমের সঙ্গে করোনা রোগীদের চিকিৎসায় আত্মনিয়োগ করেন ঢাকা মেডিক্যালের এ চিকিৎসক।
ডাক্তার তুষার জানান, শুরুতে আমি ব্রডকাস্ট জার্নালিস্ট সেন্টারের মাধ্যমে ঢাকায় কর্মরত গণমাধ্যমকর্মী ও তাদের পরিবারকেও সেবার জন্য একটি গ্রুপ করি। তিনি অলওয়েল নামের বেসরকারী প্ল্যাটফরমের মাধ্যমে ডিজিটালি করোনা রোগীদের তথ্য ডাটা আকারে সংরক্ষণ করেন; যা পরে এ রোগীদের স্বাস্থ্য নজরদারির কাজে আসবে। প্রতিটি রোগীকে ৩-৬ বার ফলোআপ করেন। কেউ ফোন না দিলে স্বেচ্ছায় ফোন দিয়ে খোঁজ নেন। তিনি বলেন, আমি যেটা করার চেষ্টা করেছি সেটা হলো রোগীকে বাড়িতে রেখেই চিকিৎসা অর্থাৎ হাসপাতালে না পাঠানো। প্রায় তিন হাজার করোনা রোগীর সেবা দিলেও এর মধ্যে মাত্র ৫৭ জনকে হাসপাতালে পাঠাতে হয়েছে। তবে অনেক রোগীকে চিকিৎসা দিতে গিয়ে ইতোমধ্যেই ১১ রোগী মারাও গেছেন সেটিও বলেন তিনি। ডাক্তার পরিবারে বেড়ে উঠা ২৮তম বিসিএসের ডাক্তার তুষার বলেন, আমার বাবা রফিক উদ্দিন ঢাকা মেডিক্যালের প্রফেসর ছিলেন মারা গেছেন। মা ঢাকা মেডিক্যাল থেকে প্রফেসর হিসেবে অবসরে আছেন। ছোটবেলা থেকেই মানুষের সেবা করা দেখছি সামনে যেমন দিনই আসুন যেন মানুষের পাশে সেবার ব্রত নিয়ে থাকতে পারি সেটাই প্রত্যাশা। করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ধাক্কা ডাঃ তুষার জানান, আমরা এরই মধ্যে দেখেছি যে করোনা সংক্রমণে বয়স্কদের মৃত্যুঝুঁকি বেশি। কিন্তু অতীত অভিজ্ঞতা থেকে বলতে চাই করোনার দ্বিতীয় ঢেউ আসার আগে বয়স্কদের পাশাপাশি শিশুদের বিষয়ে আমাদের সতর্ক হতে হবে। কারণ বড়রা নিজেদের শারীরিক সমস্যার কথা বলতে পারলেও শিশুরা তা পারে না। আর এক সময় রোজাতে দেখেছি সেহরি পর্যন্ত আমার ফোনে ফোন আসত বিভিন্ন রোগীর। রোগী সংখ্যা বেড়ে যাওয়াতে ফলোআপ নেয়ার জন্য টিমে দুইজন যুক্ত হয়েছেন প্রয়োজন হলে আরও টিম মেম্বার যুক্ত করব।